কাল বেঙ্গালুরুর তারাহীন আকাশের নিচে
মখমলের সবুজে যে নাটক মঞ্চস্থ হয়, সেটি কি কেবলই ক্রিকেট? জীবনের
মিনিয়েচারে সে তো ভারী দীর্ঘশ্বাসে ভরা এক আখ্যান! গ্রিক-ট্র্যাজেডির
প্রতিচ্ছবিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চির হাহাকারের এক উপাখ্যান।
ভারতের কাছে এই ম্যাচটি কিভাবে এক রানে
হারল বাংলাদেশ! হারার কথা না। কোনোভাবেই এই ম্যাচে পরাজিত দল হওয়ার দাবিদার
নয় লাল-সবুজের ক্রিকেট সেনাদল। উত্থান-পতনে ভরপুর বাকি ম্যাচটুকু বাদ দিন
না। শেষ ওভারের দিকে শুধু দেখুন। শেষ তিন বলে আলো ফেলুন। বাংলাদেশ
ক্রিকেটকে অন্ধকার করে দেয় ওই তিনটি বলই। জেতা ম্যাচ হারার বিষাদে নীল হয়
মাশরাফির দল। ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে রূপকথার মতো মায়াময় এক জয়তাসকিন
আহমেদ ও বাংলাদেশের ১৬ কোটি ক্রিকেটপাগলকে উপহার দিতে পারেন না মাঠের ১১
জন।
শেষ ৬ বলে চাই ১১ রান। অত সহজ হয়তো না।
কিন্তু উইকেটে যখন মাহমুদ উল্লাহ ও মুশফিকুর রহিমের মতো অভিজ্ঞ দুজন, কঠিন
আর কতটা? হার্দিক পান্ডের করা প্রথম বলে এক রানের বেশি নিতে পারেন না
মাহমুদ। টেনশন বাড়ে। পাঁচ বলে চাই ১০ রান। দ্বিতীয় বলে এক্সস্ট্রা কাভার
দিয়ে দুর্দান্ত এক বাউন্ডারি মুশফিকের। পরের বলে স্কুপটা ঠিকঠাক লাগে না,
কিন্তু চার হয়ে যায় ঠিকই। তিন বলে তখন চাই দুই রান। ম্যাচের সব উত্তেজনা
শেষ প্রায়, জয়ের সিংহাসন অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের ক্রিকেট বীরদের জন্য।
কিন্তু অমন অবস্থায় কী যে অবিমৃশ্যকারিতায় পরিচয় দিলেন জাতীয় দলে এক দশক
ধরে খেলা দুই ব্যাটসম্যান!
দুটি চার মারার পরের বলে মিড উইকেটে ক্যাচ
দেন মুশফিক (১১)। কিন্তু বল আকাশে থাকার সময় প্রান্ত বদল করায় স্ট্রাইকে
আরেক সেট ব্যাটসম্যান মাহমুদ। দুই বলে তিন রানও অমন কী! আবারও আরেক ফুলটস,
আবারও যে বলটিকে মাঠের যেকোনো প্রান্তে পাঠানো সম্ভব, সেটিকে মিড উইকেটে
ফিল্ডারের হাতে তুলে দেন মাহমুদ (২২)। তিন বলে দুই রানের প্রয়োজনীয়তা তখন
এক বলে দুই রান। কিন্তু শুভাগত হোম সেই বলটিতে ব্যাটই ছোঁয়াতে পারেন না।
দৌড়ে গিয়ে বাই রান নেওয়ার চেষ্টা করেন বটে মুস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু তাঁর
চেয়েও দ্রুত ছুটে এসে রানআউট করে দেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
ভারতের উৎসবের সশব্দ বিস্ফোরণের বিপরীতে নিঃশব্দে ডুবে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট-স্বপ্নের জাহাজ।
অথচ এর আগে বাংলাদেশ ইনিংসে এমন সব
ব্যাপার ঘটেছে, যাতে বাংলাদেশের প্রতি ছিল ভাগ্যের পক্ষপাতের ঘোষণা। জয়ের
স্বপ্ন দেখার সাহস জোগাচ্ছিল যা মাশরাফির দলকে। ইনিংসের প্রথম বলটিই ধরুন
না। ফাইন লেগে ফিল্ডারের পায়ের ফাঁক গলে হয়ে যায় চার। পঞ্চম বলে তামিম
ইকবালের রিটার্ন ক্যাচ ফেলে দেন আশীষ নেহরা। রকেটগতিতে আসা সেই বল
মুঠোবন্দি করা না হয় কঠিন। কিন্তু ১৫ রানের মাথায় তামিমের আকাশে তুলে দেওয়া
ক্যাচটি কিভাবে যে ফেলে দেন বুমরাহ, তিনিই জানেন। পরের ওভারে তিনি বোলিংয়ে
এলেন। তামিম বল সীমানাছাড়া করেন চার-চারবার। আট রানের মাথায় সাকিবের
ক্যাচও ফেলেন একবার অশ্বিন। ম্যাচের মহা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সৌম্য সরকারের
ক্যাচ মুঠোবন্দি করতে পারেন না ধোনি। বেঙ্গালুরুর রাতটি যে বাংলাদেশের হতে
যাচ্ছে, তারই টুকরো টুকরো প্রতিশ্রুতি ছিল যেন এসব ঘটনায়।
হায়, কী ভুলই না ছিল সেই প্রতিশ্রুতি!
অথচ ভারতকে ১৪৬ রানে আটকে রেখে জয়ের জ্বলজ্বলে সূর্যটা ঠিকই দেখতে পাচ্ছিল বাংলাদেশ।
শারীরিক দুর্বলতা নিয়েও তামিম কাল নেমে
যান মাঠে। প্রথম রান নেওয়ার সময় বোলারের সঙ্গে সংঘর্ষে দুর্বল হন আরো।
কিন্তু কাল যে গ্লাডিয়েটর্সের পণ এই ওপেনারের! দলকে দারুণ শুরু এনে দেওয়ার
কাজটি করেন তিনি অভিজ্ঞ যোদ্ধার মতো। সৌম্য সরকারকে পিছিয়ে মোহাম্মদ
মিঠুনকে পাঠানো হয় তামিমের সঙ্গী হিসেবে। ১১ রানে সে জুটি ভাঙলেও
বাংলাদেশকে কক্ষপথে রাখেন তামিম-সাব্বির। সঙ্গীর ক্যাচ পড়ার এক বল পর দারুণ
পুলে ছক্কা মারেন সাব্বির। ৪৪ রানের জুটি ভাঙে তামিম (৩২ বলে ৩৫) স্টাম্পড
হলে। লেগ সাইডের ওয়াইড বলে স্টাম্পড হন সাব্বির (১৫ বলে ২৬)। এর পরই
ব্যাটিং অর্ডারে বড় এক চমক। পাঁচ নম্বরে নেমে যান মাশরাফি। মুখোমুখি
দ্বিতীয় বলেই মারেন ছক্কা। ১০ ওভারে তিন উইকেটে ৭৭ রানের সুবিধাজনক জায়গায়
চলে আসে বাংলাদেশ। সাত উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ১০ ওভারে চাই মোটে ৭০ রান।
মাশরাফি (৬) এরপর বেশিক্ষণ টেকেন না।
সাকিব (১৫ বলে ২২) টপাটপ দুই ছক্কা মারলেও আউট হয়ে যান স্লিপে ক্যাচ দিয়ে।
অশ্বিনের বল তখন এমনভাবে টার্ন করছে যেন টেস্টের পঞ্চম দিনের উইকেট। সৌম্য
এসে খাবি খান, কিন্তু আউট হন না। কোনোমতে টিকে থেকে শেষ ৩০ বলে ৪৩ রানের
প্রয়োজনীয়তার সামনে এসে দাঁড় করিয়ে দেন বাংলাদেশকে।
ফর্মের সঙ্গে যুদ্ধ করা সৌম্যর ব্যাট থেকে
এমন অবস্থায়ই আসে ছক্কা। ২৪ বলে ৩৪ চাই, এরপর ১৮ বলে ২৭ রান! সৌম্য আবারও
মারেন চার। কিন্তু ফুলটস বলে ক্যাচ দিয়ে আউট হন সে ওভারেই ২১ বলে ২১ রান
করে। ঠিক পরের বলে অসাধারণ কাভার ড্রাইভে চার মেরে মাহমুদ উল্লাহ যেন
আশ্বস্ত করে আবার। শেষ ১২ বলে চাই ১৭ রান। বুমরাহর করা ওই ওভারে মাত্র ছয়
রান হয়। আবার আশঙ্কার মেঘ জমে বাংলাদেশের সম্ভাবনার আকাশে। ৬ বলে চাই ১১
রান। কিন্তু ওই জোড়া চারে সবই তো চলে আসে পক্ষে। এরপর মুশফিক ও মাহমুদের
নির্বোধের মতো শটে রূপকথার জয় আর পায় না বাংলাদেশ।
ব্যাটিং ইনিংসের মতো বোলিং ইনিংসেও তো
দুর্দান্ত ছিল মাশরাফির দল। সাত ম্যাচ পর টস জেতেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে তাঁর মাত্র এক ওভার বোলিং করা নিয়ে অনেক কথা
হয়েছে। কাল করেন পুরো চার ওভার; দেন মোটে ২২ রান। তাঁর ২৪ বলের একটিও
বাউন্ডারি মারতে পারেন না ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা।
মাশরাফির সেদিনের অধিনায়কত্ব নিয়েও তো কম
শোরগোল ওঠেনি। দলকে উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ, বোলিং পরিবর্তন প্রশ্নবিদ্ধ,
ফিল্ডিং পজিশনও ঠিক নয়—আরো কত কী! কাল ভারতের বিপক্ষে সেই মাশরাফির
অধিনায়কত্বের জয়ধ্বনি ওঠে আবার। তাঁর প্রশংসায় বিশেষণের ভাণ্ডারে টান পড়ে
যাওয়ার দশা।
এই যেমন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ইনিংসের
প্রথম পাঁচ ওভার আলাদা পাঁচ বোলার দিয়ে করান মাশরাফি। সাফল্য ছিল না বলে
সেটি আলোচিত না। কালও আলাদা আলাদা পাঁচ বোলারে সাফল্য আসে না ঠিক। কিন্তু
যেই না প্রথম বোলার হিসেবে মুস্তাফিজের স্পেল নিয়ে যান দ্বিতীয় ওভারে,
উইকেট তাতেই। এই পেসারের স্লোয়ার বুঝতে না পেয়ে ক্যাচ দেন রোহিত শর্মা
(১৮)। দ্বিতীয় বোলার হিসেবে সাকিবকে দ্বিতীয় ওভারে টেনে নেন মাশরাফি।
সেখানে আবার শিখর ধাওয়ান (২৩) এলবিডাব্লিউ। তাঁর নেতৃত্বের জয়ভেঁপু বাজবে
না কেন!
আর এখানেই তো শেষ না। বিরাট কোহলি-সুরেশ
রায়নার জুটিতে রান হয়ে যাচ্ছে। ১৪তম ওভারে বোলিংয়ে আনেন শুভাগত হোমকে। তাঁর
অফস্পিনে বোল্ড কোহলি (২৪)। ভেঙে যায় ৫০ রানের জুটি। আবার উইকেট পাওয়ার
পরের ওভারে তাকে দিয়েই তো সাধারণত বোলিং চালিয়ে নেওয়া দস্তুর। মাশরাফি
কিন্তু শুভাগতকে সরিয়ে নিয়ে আসেন আল-আমিন হোসেনকে। এই পেসার পর পর দুই বলে
আউট করেন সেট হওয়া সুরেশ রায়না (৩০) ও ভয়ংকর হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া
হার্দিক পাণ্ডেকে (১৫)। এর মধ্যে পরের উইকেটে সৌম্য সরকারের ক্যাচটির
উল্লেখ না করা অন্যায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে ইডেন গার্ডেন্সে ধরেছিলেন প্রায়
অলৌকিক এক ক্যাচ। কালও অবিশ্বাস্যভাবে বাউন্ডারি লাইনে বাঁয়ে ঝাঁপিয়ে
মুঠোবন্দি করেন পাণ্ডেকে।
এই যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, সেরা অস্ত্র
মুস্তাফিজের দুটো ওভার কিন্তু ঠিক রেখে দেন মাশরাফি। ১৮ ও ২০ তম ওভারের
জন্য। প্রথমটি থেকে আসে মাত্র পাঁচ রান। আর শেষ ওভারের প্রথম বলে আউট করেন
রবীন্দ্র জাদেজাকে। ক্রিজে মহেন্দ্র সিং ধোনি থাকা সত্ত্বেও ৯ রানের বেশি
হয় না। মাশরাফির অধিনায়কত্বের জয়নিশান তুলেই তাই শেষ হয় ভারতের ইনিংস। সাত
উইকেটে ১৪৬ রানের চেয়ে বেশি করতে পারে না তারা। ওপেনিং জুটিতে ৪২ রান উঠে
যায়, ১৪তম ওভারে দুই উইকেটে ৯৫ রানের সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে যায়, ক্যাচ
পড়ে দুটো—কিন্তু এত সব সত্ত্বেও ভারতের রান থেকে যায় বাংলাদেশের নাগালের
মধ্যে।
আর মুশফিকের ওই দুটো বাউন্ডারির পর জীবনের
মিনিয়েচারে ক্রিকেট মাঠে সাফল্যের আগাম ছবিটাই আঁকছিল বাংলাদেশ। দুজন
অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের নির্বুদ্ধিতায় সেটি কিভাবেই না পরাজয়ের কাব্য হয়ে
রইল!
বাংলাদেশ ক্রিকেটে আগামী দুই-চার, পাঁচ-দশ
বছরেও এই আফসোস যাবে না। পেছন ফিরে তাকালে ওই একটি প্রশ্নই ঘুরে-ফিরে আসবে
বারবার—এই ম্যাচটি কী করে হারল বাংলাদেশ!
No comments:
Post a Comment